শ্রী পার্থ ব্যাণার্জির স্মরণে 🎗️
শ্রী পার্থ ব্যাণার্জির সঙে চিত্র ৩১শে জানুয়ারি ২০১৮ |
তখন ক্লাস সেভেন এ পড়ি | পড়াশুনার চাপ কম, জটিল ক্যাল্কিউ্যলাস্ (পাথুরি) গণীতের দিন তখনো বহু দূর। রসায়ন তখনো হাজার পাতা লম্বা ফর্মুলা দিয়ে রাতের ঘুম ছিনিয়ে নেয়নি। স্কুলের দিন গুলি অানন্দে, হেসে খেলে কেটে যায়। এমনই এক দিন অামার দেখা হয় তাঁর সাথে।
খুব সাধারণ ভাবেই কেটে গিয়েছিল আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব। ইস্কুলের দুই বাড়ির মধ্যস্থতানে যে প্রকান্ড মাঠটি অছে, তার ঠিক মাঝ্খানে তাঁর সাথে কথা হয়। ইংরেজিতে করলেন প্রশ্ন - "Why are you out of class?"
ইস্কুলে নিয়ম ছিল কড়া। ক্লাস ফাঁকি দিতে গিয়ে ধড়া পড়লে কড়া সাস্তি হবে। অবশ্য সেই দিন অমি ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছিলাম না। বগলদাবা করা বইগুলি দেখিয়ে নিশ্চিন্তে বললাম - "I’m on my way to the computer lab. I have a class there."
তিনি নিজেও কম্পিয়ুটারেরই শিক্ষক। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াতেন। তবে সেই সময় অামার বিভাগ কে পড়াতেন না। উত্তর দিয়ে যেই না দু - পা বাড়াবো, অাবার একটা কথা প্রশ্ন - "You’re Ritam, right?"
আমি “Yes, Sir” বলতে, তিনি মৃদু মাথা নাড়িয়ে উল্টোপথে হেঁটে চলে গেলেন। অমিও আমার ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। দু - মিনিটের মধ্যে সমাপ্ত হল প্রথম সাক্ষাৎকার।
এর পর অারো কয়েকবার দেখা হয় তাঁর সাথে। তবে সবচাইতে পরিস্কার ভাবে মনে অাছে অাবৃত্তি প্রতিযোগীতার অাগের দিনগুলির কথা। ইস্কুলে, ছাত্রদের চারটি বিভাগ বা হাউস এ ভাগ করা হত। অমি ছিলাম মাকাউলে হাউস এ। তিনি ছিলেন অামাদের হাউস এর প্রধান উপদেষ্টা তাই প্রত্যেক অনুষ্ঠানে এবং অন্তর - বিভাগিয় প্রতীযোগীতায় তিনি পৃফেক্ট নিযুক্ত করার সাথে সাথে নিজেও মাঝে মাঝে এসে মহলা দেখে যেতেন।
এমনও অনেকবার হয়েছে - আবৃত্তির রিহার্সল চলছে, হঠাৎ তিনি থামিয়ে দিয়ে একটি অংশ নিজেই পড়ে শোনালেন। শিখিয়ে দিলেন কেমন করে আবৃত্তি করতে হবে। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী অংশটি ফের আবৃত্তি করতাম। সেই সব সময়ের কথা ভাবলে, তাঁকে শ্রেফ কম্পিয়ুটারের শিক্ষক বলা চলে না।
যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি, তখন ইস্কুলের বাংলা ক্লাব এ যোগ দিয়েছিলাম। এই গল্প নিয়ে এগিয়ে যাবার আগে ক্লাব সম্পর্কে দুটো কথা বলি। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রদের জন্য অামাদের ইস্কুলে ক্লাবের ব্যবস্থা অাছে। বাংলা ক্লাবে যে ছাত্ররা সাধারণত যোগদান করে, তারা বাঙালি অথবা বাঙলা ভাষা প্রেমী। অামাদের ক্লাব বাংলা ভাষা এবং তার সংস্কৃতিকে ছাত্রদের কাছে পৌছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। এই ক্লাবেও তাঁকে পেয়েছি। বাংলার শিক্ষক না হলেও নিজের মাতৃভাষা কে প্রচন্ড স্নেহ করতেন, তাই এই ক্লাবে তার উৎসাহিত যোগদান। বার্ষিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠানে মাইক হাতে প্রচারকের দ্বায়িত্বে দেখেছি তাকে বছরের পর বছর।একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে তার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। যখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ি, তিনি অামাকে বলেছিলেন - "ঠিক করে পড়াশোনা করবি, তোকে অমি পৃফেক্ট করতে চাই। ভাল নম্বর লাগবে তার জন্য।" সেবারের অন্তর - বিভাগীয় বাংলা বিতর্ক প্রতিযোগীতায় তিনি বেশ অনেকটাই সাহায্য করেছিলেন অামাদের মাকাউলে হাউসের দল কে। অামরা জয়লাভ করেছিলাম।
আগামী বছর (দ্বাদশ শ্রেণীতে) অমি পৃফেক্টের পদ পাই। ভাল করে জানতাম তার সাহায্য না থাকলে এর কোন সম্ভবনাই ছিল না। পৃফেক্ট হয়ে অনেক ছেলেকে নিয়মভঙ্গ করার জন্য সাস্তি দিয়েছি। আমার কাজ করার পদ্ধতিতে অনেকেই প্রতিবাদ জানিযেছিল ইস্কুলের প্রশাসনের কাছে এবং প্রধান শিক্ষক মহাশয় আমাকে বার কয়েক ডেকেও পাঠিয়েছিলান। এই সব সমস্যা অধিকাংশ সময় অবশ্য তিনিই মিটিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের কাছে অামার পক্ষে কথা বলে, কখনো বা অামার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ নিজেই সামলে। অামাকে বারে বারে বলতেন - "তুই যা করছিস, তা চালিয়ে যা। এরা কেউ পৃফেক্টদের কাজ করতে দেখতে অভ্যস্ত নয় তাই এরকম আপত্তি জানাচ্ছে। মনে রাখিস - সবার আগে আসে স্কুল, তারপর হাউস্, তারপর তুই।" কথাটি নিজের ক্ষেত্রেও পালন করতেন। এরম করে বছরটি কেটে গেল। উচ্চমাধ্যমিক অনুরূপ আই. এস্. সি. পরীক্ষা দিয়ে মার্চ মাসে পার করে গেলাম ইস্কুলের গন্ডি।
এদিকে নানান ব্যস্ততার মধ্যে তার সাথে যোগাযোগ কমে গেল। হঠাৎ খবর পেলাম তিঁনি ইস্কুলে মাকাউলে হাউসের প্রধানের পদ ত্যাগ করেছেন। সেই দিন বিকেলে তাঁকে ফোন করি। তিঁনি জানান তাঁর শরীর ভাল নেই; তাই প্রধান উপদেষ্টার মতন পরিশ্রমের কাজ তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না।আমি এ ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলাম যে তাঁর শরীর খারাপ ছিল। অত্যধিক রক্তচাপের কারণে তাঁর শরীরে অনেক রোগ দেখা দিযেছে। তাঁকে স্বাস্থের খেয়াল রাখতে বলি। কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম যে তিঁনি অামার সাথে কথা বলতে পেরে বেশ খুশি হয়েছেন। ১৩ জুন ২০১৮ সালে অামার জন্মদিন ছিল। সেই দিন দুপুরে প্রত্যাক বারের মতন উনি আমায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। সেবারেও তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্বাস্থের প্রতি নজর দিতে বলি।
পরবর্তি দিন - ১৪ জুন ২০১৮। রাত তখন ১০টা। হঠাৎ ফোনটি বেজে উঠল। খবরটি শুনে চমকে গেলাম। তিনি কিছুক্ষণ আগে আমাদের ছেরে পরলোক গমন করেছেন। খবরটি শোনার পরে কি অনুভুতি হল তা অমি লিখে প্রকাশ করতে পারব না।
সাত দিন পর ইস্কুলে আয়োজিত শোকসভায় তাঁর সেই কথাটি মনে পড়ে গেল - "আগে স্কুল, তারপর হাউস্, তারপর তুই।"
লহ প্রণাম।
Comments
Post a Comment